আর্থিক নিপীড়ন একটি গুরুতর বিষয়। আপনার স্বামী বা স্ত্রী কি আর্থিক হেনস্থাকারী? আপনাকে আর্থিকভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে কি না তা আপনি এখানে খুঁজে পেতে পারেন।
টাকা পয়সা নিয়ে মনোমালিন্য প্রত্যেকটা সংসারেই করে থাকে। এটি প্রত্যেকটি সম্পর্কের একটি অংশ। আপনি কি একমত না? ঠিক আছে আপনি কি মেনে নিবেন যদি আপনি একটু বেশি টাকা খরচ করলে আপনার সঙ্গী চিৎকার করে ওঠে? সে যদি আপনার ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যায় অথবা আপনার প্রতি মাসের বেতনের টাকা তাকে দিয়ে দিতে বলে তা কি আপনি মেনে নিবেন? সম্ভবত না। যদি এরকম হয়ে থাকে তাহলে আপনি আর্থিকভাবে নিপীড়িত। এবং আপনার স্বামী-স্ত্রী আপনার আর্থিক নিপীড়নকারী।
জি, ঠিক ধরেছেন। আর্থিক নিপীড়ন আপনার জন্য একটি নির্যাতন ঠিক যেমনটি ঘরোয়া নির্যাতন। এমনকি আর্থিক নির্যাতন এর ক্ষেত্র অনেক বড় হতে পারে যেমন যৌথ একাউন্ট থেকে আপনাকে না জানিয়ে আপনার টাকা খরচ করা, আপনার নামে ঋণ করা, সমস্ত খরচ আপনাকে বহন করতে বলা এমনকি আপনার সব খরচ চোখে চোখে রাখা এর মধ্যে পড়ে।
শুরুতেই আপনি আর্থিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়তো হবেনা। শুরুর দিকে আপনার স্বামী বা স্ত্রী হয়তো আপনার ব্যাংক স্টেটমেন্ট গোপনে পর্যবেক্ষণ করবেন, কিংবা আপনি কেনাকাটা করলে তার রিসিভ চাইবেন। মনে রাখবেন, আর্থিক নির্যাতনের শিকার পুরুষ এবং নারী উভয়েই সমানভাবে হয়ে থাকে।
কিভাবে একজন মানুষ অর্থনৈতিক অনাচারী হয়ে উঠে? আসলে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে যেমন আগের কোন বাজে অভিজ্ঞতা, নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা, এমনকি ঋণ থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে না পারায় ডিপ্রেশন এর কারনেও হতে পারে। কারণ যাই হোক না কেন, কারো নিজস্ব হতাশা কখনোই আপনার উপরে কেউ চাপিয়ে দিতে পারে না। আমরা কেউই চাইনা অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হতে। এখানে আমরা বর্ণনা করব কিভাবে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনার করে অর্থনৈতিক নির্যাতন করছে কিনা।
আপনি কি বাজেটের চেয়ে অল্প কিছু টাকা বেশি খরচ করার জন্য বকা খান?
আপনার সঙ্গীর এই নিয়ন্ত্রণ করা অভ্যাস থেকে পরবর্তীতে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। এটা ঠিক যে আপনি আপনাদের সংসারের বাজেটের যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছুটা বেশি খরচ করে ফেলেছেন। এজন্য আপনার সঙ্গী আপনার সাথে মন খারাপ করতে পারে কিংবা অভিমান করতে পারে। তার মানে এই না যে সে আপনার সাথে বকাবকি বা চিল্লাচিল্লি করবে। তার মানে এই না যে সে আপনাকে আঙ্গুল তুলে শাসাবে। তাই আপনার স্বামী বা স্ত্রী যদি আপনাকে বাজেটের বাইরে খরচ করার জন্য কিছু বলে থাকে, তাহলে এটি চরম আকার ধারন করার আগেই তার সাথে আলোচনা করে সমস্যাটির সমাধান করুন।
আপনার স্বামী বা স্ত্রী কী সংসারের নগদ টাকা কে অন্যায়ভাবে ভাগ করে দেয়?
টাকা-পয়সার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কথা বলুন। যখন সংসারের অতিরিক্ত টাকার বিষয়ে আসে, তখন কি আপনার স্বামী বা স্ত্রী বেশিরভাগ টাকা তার খরচের জন্য রেখে দেয়? যদি তাই হয় তাহলে আপনি একজন কঠিন নিয়ন্ত্রণকারীর খপ্পরে পড়েছেন। যদিও আপনার সঙ্গী আপনার থেকে বেশি আয় করে, তারপরেও অতিরিক্ত টাকা আপনাদের সমানভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করা উচিত। কিন্তু সে যদি বলে আমার টাকা আমার ইচ্ছেমত অনেক খরচ করব, তাহলে জেনে নিবেন সে আপনার উপরে অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে।
আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনার ক্রেডিট কার্ড নিয়ন্ত্রণ করে?
আপনি যদি ক্রেডিট কার্ড এর ব্যবহার অনেক বেশি করেন, তাহলে আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনাকে আপনার অতিরিক্ত ব্যয় সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়া যুক্তিযুক্ত। এতে কোন সমস্যা নেই যদি সে আপনার বিভিন্ন জিনিসের যেমন কাঁচা বাজার, ইউটিলিটি বিল, এবং অন্যান্য খরচের একটা হিসেব করে দেয় যেগুলো আপনি ক্রেডিট কার্ডে পরিশোধ করতে পারবেন। কিন্তু যদি আপনার আমি ভাই আপনার ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যায়, অথবা আপনার সম্পূর্ণ খরচ এর উপরে নজরদারি করে তবে সে আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে। এবং আপনি অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন।
আপনার স্বামী বা স্ত্রী কি আপনার আয় কে অবমূল্যায়ন করে?
কারো কাউকে ছোট করে দেখা কখনই ভাল লক্ষন না, অন্তত যখন আপনি কারো সাথে সংসার করবেন। এটা পরিষ্কারভাবে অর্থনৈতিক নির্যাতন। নারী এবং পুরুষ উভয়েই এই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই ঘটনা প্রায়ই দেখা যায় যে, স্ত্রীরা অনেক আয়ের উপরে খুশি না। সবসময় তাকে খোঁটা দিতে থাকে। পরিচিত কারো সাথে সবসময় ছোট করে তুলনা করে। আবার অনেক সময় যেসব স্বামীরা স্ত্রীদের চেয়ে অনেক বেশি টাকা আয় করেন, তাদের অনেকে স্ত্রীদের খোঁটা দেন যে সে কম টাকায় করেও অনেক বেশি খরচ করেন।
আপনার কি নিজের প্রতিটা বেতন আপনার স্বামী বা স্ত্রীকে দিতে হয়?
সত্যি কথা বলতে গেলে সংসারে যে বেশি টাকা আয় করে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকবে। তার মানে এই না যে তারা তাদের স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি মাসের বেতনের টাকা ও তার কাছে নিয়ে রেখে দিবে। আপনার সঙ্গী যদি আপনার সাথে এরকম আচরণ করে তাহলে পরিস্কার ভাবে সে আপনার উপরে অর্থনৈতিক নির্যাতন করে চলেছে।
আপনাকে কি মাসিক ভাতা দেওয়া হয়?
এ ধরনের আর্থিক নির্যাতনের শিকার মূলত তারাই হয় যারা সংসারে আয় করেন না। এক্ষেত্রে সংসারের আয় করা ব্যক্তি অন্য সঙ্গীর জন্য একটি নির্দিষ্ট মাসিক ভাতা প্রদান করেন। এটা অনেকটা প্রতিদিনের খরচের পকেট মানির মত। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করা ভাল, যতক্ষণ স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একটি নির্দিষ্ট খরচের টাকা হিসাব করে নেন। কিন্তু একজনের উপরে যদি খরচের টাকা ভাতা হিসেবে প্রদান করা হয় তাহলে এটি লাল সংকেত। এবং আপনার সঙ্গী আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছেন।
আপনার সঙ্গী কি সংসারে আর্থিক ব্যবস্থাপনা করেন?
এটা খুবই স্বাভাবিক যে সংসারে বেশি আয় করা ব্যক্তি সংসারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা করবেন। কিন্তু তাতে সে যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাহলে কি হবে? সে যদি অন্য জনকে বেশি খরচ করার জন্য দোষারোপ করতে থাকে অথবা সংসারের দেনা বাড়াতে থাকে তাহলে কি হবে? তাহলে অবশ্যই এটা আর্থিক নির্যাতন। আপনার স্বামী বা স্ত্রী সংসারের অধিকারী হোক বা না হোক, সে একা মাসের বাজেট নির্ধারণ করতে পারে না। এটি একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। কোন কারণে যদি আপনাদের আর্থিক অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে যায়, তখন একসাথে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে আসুন। একে অপরকে দোষারোপ করে কোন লাভ হবে না। হবে কি?
আপনি এখন জানেন যে আপনি আপনার সংসারে আর্থিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন কিনা। যদি হয়ে থাকেন তাহলে আপনি অবশ্যই জানতে চাইবেন কি ভাবে থেকে আপনি মুক্তি পেতে পারেন। এখানে আমরা কয়েকটি পরামর্শ দিচ্ছি যা আপনাকে আর্থিক নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারে:
পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক তা যাচাই করুন
আপনার উপর আর্থিক নির্যাতন কতটা ভয়ানক পর্যায়ে গিয়েছে? আর্থিক নির্যাতন চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে পরিবারে আপনার সম্পর্ক সম্পূর্ণ অপমানজনক হয়ে উঠবে। যদি আপনি মনে করেন আর্থিক নিপিরণ দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে, তখন আপনার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে হবে এবং প্রয়োজনে পারিবারিক মুরব্বির সাথে আলোচনা করুন।
কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করুন
অনেক সময় কথা বলে অনেক বড় সমস্যার সমাধান করা যায়। আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সাথে একটি আন্তরিক আলোচনা আপনাদের আর্থিক নির্যাতনের মূল কারণ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। এমন হতে পারে যে আপনার সঙ্গী খুবই খারাপ আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাই সে হয়তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তখন একসাথে আলোচনা করে আপনারা একটি সমাধানের চেষ্টা করতে পারেন।
আপনার অনুভূতি গুরুত্বপূর্ণ
আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করছে তার উপরে নজর না দিয়ে আপনার নিজের অনুভূতি দিকে নজর দিন। আর্থিক নির্যাতনের পরে আপনার মনের অবস্থা কিরকম হয়ে দাঁড়ায়? কেউ আপনাকে আর্থিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে আপনার কি অনুভূতি হয়? আপনার মনের অবস্থা আপনার সঙ্গীর সাথে আলোচনা করুন। ব্যাপারটা এমন যে আপনি আপনার সঙ্গীর ভুল গুলো না ধরিয়ে দিয়ে বরং আপনার মনের অনুভূতি প্রকাশ করুন।
কিছু আর্থিক পরামর্শ সম্পর্কে চিন্তা করেছেন?
কখনো কি চিন্তা করেছেন যে কোনো আর্থিক পরামর্শদাতার সাথে আলোচনা করলে আপনার সমস্যার সমাধান হতে পারে? আপনি যখন আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সাথে টাকা পয়সা নিয়ে মনোমালিন্য করেন এবং সমাধান পাবেন না, তখন তৃতীয় পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারেন। একজন অভিজ্ঞ মানুষের সাথে আলোচনা করলে সে আপনাদের আর্থিক সমস্যা সমাধান করার উপায় বলে দিতে পারে।
ভূমিকা পরিবর্তন করুন
আপনার সংসারে এমন হতে পারে, যে আপনি সবসময় টাকা জমা দিচ্ছেন এবং আপনার সঙ্গী উল্টোদিকে টাকা খরচ করছে। এই অবস্থায় আপনারা নিজেদের ভূমিকা পরিবর্তন করে দেখতে পারেন। এক্ষেত্রে একমাসে আপনি বাজেট এবং সঞ্চয় দায়িত্বে থাকবেন অন্যদিকে আপনার সঙ্গী সমস্ত খরচ ও বিনিয়োগের দায়িত্ব নিবে। পরের মাসে আপনাদের পরিবর্তন করে দেখেন। বুদ্ধিটা ব্যতিক্রমী হলেও আপনাদের মজাদার একটি অভিজ্ঞতা দিবে।
অন্যদের সাহায্য নিন
আপনার উপরে আর্থিক নির্যাতন যদি চরম আকার ধারণ করে তাহলে দেরি না করে অন্যদের সাহায্য নিন। আমরা সবাই চাই আমাদের সংসার সুখের হোক। শুধুমাত্র কিছু ভুলের জন্য সংসারে টানাপড়েন কখনো কাম্য নয়। তাই সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য বেশি দেরি না করে আগেভাগেই চেষ্টা করুন।