টাকা-পয়সা বিষয়ে কয়েকটি ভুল ধারণা অনেক মানুষকে অর্থ বিত্তের খেলায় পরবর্তী ধাপে যেতে দেয় না। আপনিও কি সেই দলে ? আসুন অর্থ বিষয়ক কয়েকটি মিথ বা শ্রুতিকথা আমরা জেনে নেই এবং আসলেই এগুলো কত বড় ভুল তা আপনারা নিজেরাই দেখতে পারবেন।
মিথ ১ – বিনিয়োগ শুধুমাত্র ধনী ব্যক্তিদের জন্য
এই মনোভাব যদি আপনাকে বাধাগ্রস্ত করে থাকে, তাহলে পড়তে থাকুন। অবশ্যই যাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয়ের আছে, তারা সহজেই বিনিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু তার মানে এই না যে বাকিরা বিনিয়োগ করতে পারবেন না।
এই কথাটি আপনি মাথার মধ্যে গেঁথে ফেলুন- আপনি চাইলেই সবসময় আপনার সঞ্চয় ও বিনিয়োগের জন্য অল্প কিছু টাকা সরিয়ে রাখতে পারবেন। আপনি যদি একদম অল্প পরিমাণে টাকা জমা করতে থাকেন তাহলেও কোন সমস্যা না। শুরুর দিকে টাকার অংকটা বড় না অভ্যাসটাই বড় কথা। একবার অভ্যাসটা চালু হয়ে গেলে, পরে যখন আপনার সুযোগ হবে তখন আপনি বেশি পরিমাণে জমানো বা বিনিয়োগ করতে পারবেন।
মিথ ২ – স্বর্ণের বিনিয়োগ শ্রেষ্ঠ
আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক এবং ইতিহাস হিসাব করলে আমরা দেখতে অনেকে স্বর্ণের উপরে বিনিয়োগ করে থাকেন যেহেতু এর একটি মূল্য আছে। এদের সাথে সাথে একটা জিনিস মাথায় রাখা দরকার যে আপনার স্বর্ণের উপর বিনিয়োগ করে তেমন টাকা বাড়ে না। তার থেকে আপনি অন্য দেশে বিনিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে তার দিকে নজর দিতে পারেন। যেমন ধরুন বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, একটা লম্বা সময় পরে আপনাকে ভালো আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেবে। স্বর্ণের উপর বিনিয়োগ করলে আপনি বলতে পারবেন না যে একটা লম্বা সময় পরে, যেমন পাঁচ বছর বা দশ বছর পরে স্বর্ণের দাম বাড়বে। যদি দাম না বাড়ে তাহলে আপনার স্বর্ণের বিনিয়োগ করে তেমন কোনো টাকা বাড়বে না।
মিথ ৩ – নগদ অর্থ প্রদানই সেরা
যদিও আমরা সবসময় বলে থাকে যে নগদ টাকা দিয়ে কেনাকাটা করা উচিত। এটা ঠিক যে, নগদ টাকায় কেনাকাটা করলে সবসময় আমরা আমাদের ব্যয় সীমার মধ্যে থাকতে পারব। তার মানে এই না যে সবসময় আপনাকে নগর টাকা দিয়ে কেনাকাটা করতে হবে। আপনার কাছে যদি একটি ক্রেডিট কার্ডের অপশন থাকে এবং আপনি যদি আপনার আয়-ব্যয়ের হিসাব করে ঠিকভাবে কেনাকাটা করতে পারেন তাহলে আপনি ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা নিতে পারবেন।
বেশি নগদ টাকা নিয়ে চলাফেরা করলে যেরকম আপনি অস্বস্তি বোধ করবেন, তেমনি টাকা ছাড়া বড় একটা ভয় থাকে। তার ওপরে বিভিন্ন আবহাওয়ায় কাগজের টাকা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই তুলনায় ক্রেডিট কার্ড নিরাপদ। আর যদি আপনার হারিয়ে যায় তাহলে আপনি সাথে সাথে তা বন্ধ করতে পারবেন। এবং ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ধরার জন্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলো বেশ সক্রিয়। কিন্তু আপনার টাকা চুরি হয়ে গেলে আপনার কিছুই করার থাকবে না। এখন আমাদের দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গুলো অনেক ভালো কাজ করছে। অনেক পণ্য বা সার্ভিস এর অর্থ আপনি মোবাইল ব্যাংকিং এ সাহায্যে পরিশোধ করতে পারবেন। আর ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিং এ টাকা পাঠানো এখন ফ্রী।
মিথ ৪ – ক্রেডিট কার্ডগুলি জরুরি তহবিলের মতো
আপনার হঠাৎ করে টাকার দরকার হলে ক্রেডিট কার্ড অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করতে পারে। তার মানে এই না যে ক্রেডিট কার্ড সত্যিকারঅর্থে আপনার আপদকালীন তহবিলের বিকল্প। অন্যভাবে বলতে গেলে আপনি যদি মনে করে ক্রেডিট কার্ড থাকা মানে আপনি আর্থিকভাবে বিপদমুক্ত তা ভুল ধারণা।
ক্রেডিট কার্ড হতো এককালীন কোন এক সময় আপনার কোন একটি জরুরী অবস্থাতে সাহায্য করতে পারে। তারমানে সবসময়ের জন্য আপনার একটি জরুরী তহবিল হিসাবে আপনি ক্রেডিট কার্ড কে বিবেচনা করতে পারেন না। একটি সুপরিকল্পিত জরুরী তহবিল আপনি জমা করে ফেলুন।
মিথ # ৫: আপনার ছয় মাসের ব্যয় আপনার জরুরি তহবিলের জন্য যথেষ্ট
যদিও কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই, তারপরও অনেক সময় বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন যে ছয় মাসের ব্যয় অন্ততপক্ষে জরুলি তহবিলের জন্য রেখে দেয়া উচিত। তবে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে। যেমন ধরুন আপনি যদি তরুণ হলে এবং আপনার উপর যদি পরিবারের সবার দায়িত্ব না থাকলে, তখন জরুরী তহবিল কম হলেও তেমন সমস্যা নেই। আবার বয়স্কদের জন্য জরুরি তবে বেশি থাকা উচিৎ। কারণ তাদের অনেক সময় অসুখ-বিসুখ এর কারণে অনেক টাকা খরচ হয়ে যেতে পারে। জেনে নেই কোনও যাদু নম্বর নেই। বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই ছয় মাসের মূল্যমানের জীবনযাত্রার ব্যয় সাশ্রয়ের পরামর্শ দেন। তবে প্রত্যেকের চাহিদা আলাদা। যারা ব্যবসা করছেন বা কোনও ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পে কাজ করেন তবে তাদের আরও বেশি সঞ্চয়ের প্রয়োজন হতে পারে।
এছাড়া কোভিড-১৯ মহামারী থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে জরুরি অবস্থা কতটা দীর্ঘস্থায়ী ও থাকতে পারে। এ মহামারীর সময় অনেকেই কাজ হারিয়েছেন, তাদের নতুন করে কাজ করা এতটা সহজ না।
মূলত এসব বিষয়গুলো মাথায় রেখে আপনার জন্য কতটুকু জরুরী তহবিল সঞ্চয় করা উচিৎ তা বিবেচনা করবেন।
মিথ # ৬: আমি তরুণ, আমার সঞ্চয় করার অনেক সময় আছে
অনেকে আমরা চিন্তা করে থাকে যে আমাদের অবসর সময়ের জন্য আমরা যে পরিমাণ সঞ্চয় করব তা আমরা আরো পরে শুরু করতে পারি। কারণ তরুণ বয়সে আমাদের তেমন উপার্জন থাকেনা। আমরা চিন্তা করি যে আমাদের যখন উপার্জন বাড়বে তখন আমরা সন্ত্রাস শুরু করব।
বাস্তবে আপনি যদি অল্প বয়স থেকেই সঞ্চয় তহবিল শুরু করেন, এ সঞ্চয়টি দীর্ঘমেয়াদী কোনও পরিকল্পনায় থাকলে প্রত্যেক বছর চক্রবৃদ্ধিহারে অনেক বছর ধরে আপনাকে টাকা দিতে থাকবে।
মিথ # ৭: আমার অ্যাকাউন্ট এ অনেক টাকা আছে আমার বাজেটের দরকার নেই
আপনি চিন্তা করতে পারেন বাজেট তো এমন লোকদের জন্য যাদের আয়-রোজগার কম। তারা তখন চিন্তা করবে স্বল্প আয়ের কিভাবে চালাতে হয়। আমার যথেষ্ট টাকা আছে; তাহলে বাজেট আমার জন্য কেন?
আসল কথা হচ্ছে গিয়ে বাজেট সবার জন্য। আপনি যদি বাস্তবসম্মত একটি বাজেট না করেন, তাহলে আপনার লাখ টাকার বেতন হলেও আপনি মাস শেষে ধারের মধ্যে থাকবেন। বাজেট আপনাকে আপনার আয় অনুযায়ী ব্যয় করতে বাধ্য করে। এবং আপনাকে সবসময় আপনার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে দেয়।
মিথ ৯: ফিক্সড ডিপোজিট নিরাপদ এবং সেরা
ফিক্সড ডিপোজিটে যে বিনিয়োগ করবেন না তা আমরা কখনও বলছি না। ফিক্সড ডিপোজিট সবসময় আমাদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেয় এবং সত্যিই এটি নিরাপদ। তবে খেয়াল রাখবেন আপনি যদি আপনার সমস্ত টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখেন তাহলে কেনাকাটার জন্যে হাতে টাকা কমে যাবে। যখন তখন এই টাকা বের করে নিয়ে পারবেন না। তার উপর মুদ্রাস্ফীতি অনুযায়ী আপনার টাকা ততটা বাড়বে না। তাই অন্যান্য যে বিনিয়োগের বিকল্পগুলো রয়েছে, যেমন স্টক, ছোট কোনও কোম্পানিতে বিনিয়োগ, এগুলো ভেবে দেখতে পারেন। এ ধরনের বিনিয়োগের ঝুঁকি থাকলেও আপনার মুনাফা করার সম্ভাবনাও বেশি।
মিথ ১০: বিনিয়োগ হচ্ছে জুয়া খেলার মত
এটা সত্যি যে বিনিয়োগের কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই হয়তো অনেকের সাথে তুলনা করতে পারে। বিনিয়োগের সাথে অনেক ঝুঁকি রয়েছে এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি আপনি বিচার-বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করলে আপনি আপনার ঝুঁকি কমাতে পারবেন।
আপনি যখন নিজের আর্থিক রোডম্যাপ তৈরি করার সময় এই ভুল ধারণা গুলি মাথা থেকে সরিয়ে পরিকল্পনা করবেন। তাহলে আপনি আপনার অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সময় আপনার ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।